
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৫০ জনেরও বেশি নিহত; লেবাননে হামলা অব্যাহত
ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলায় গাজায় আবারও রক্ত ঝরল। গতকাল শনিবারের হামলায় অন্তত ৫১ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে শুধু গাজা সিটি থেকেই ২৭ জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে এক পরিবারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে পুরো পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে।
গাজার হাসপাতালগুলোতে লাশ আর আহতদের অন্তহীন সারি এখন নিত্যদিনের দৃশ্য। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আহতদের সংখ্যা এত বেশি যে চিকিৎসা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সরঞ্জাম, ওষুধ বা জনবল নেই। অবরুদ্ধ উপত্যকায় মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
শুক্রবার জাতিসংঘে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক উদ্ধত ভাষণ দেন। ভাষণ শুরুর আগে প্রতিবাদ জানিয়ে একাধিক দেশের প্রতিনিধি সভা ত্যাগ করেন। বক্তব্যে নেতানিয়াহু কোনো অপরাধ স্বীকার না করে বরং গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোকে কঠোর সমালোচনা করে বলেন, এসব দেশ উগ্রবাদকে পুরস্কৃত করছে।
নেতানিয়াহু দাবি করেন, চলমান যুদ্ধই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আব্রাহাম চুক্তির পরিসর এ যুদ্ধের কারণেই বাড়বে। তার বক্তব্য শেষ হওয়ার একদিন পরই গাজায় নতুন করে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটল।
ইসরায়েলি বাহিনী এখন গাজার সবচেয়ে বড় শহর গাজা সিটি দখলের জন্য অভিযান চালাচ্ছে। শহরটিতে হামলা শুরুর আগে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাস করতেন। টানা আক্রমণের কারণে কয়েক লাখ মানুষ ইতিমধ্যে শহর ছেড়ে অন্যত্র গেছেন। কিন্তু এখনো কয়েক লাখ ফিলিস্তিনি গাজা সিটিতে আটকা পড়ে আছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আকাশ থেকে নিরবচ্ছিন্ন বোমা বর্ষণ এবং স্থল অভিযান দুই দিক থেকে চলছে। রাস্তাঘাট, বাজার, আবাসিক ভবন, এমনকি হাসপাতাল ও স্কুলও হামলার বাইরে থাকছে না। শহরের প্রতিটি কোণায় ধ্বংসস্তূপ আর ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে থাকা মানুষের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে।
৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ৬৫ হাজার ৫৪৯ জনে। এর মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশুসহ বেসামরিক মানুষ। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫১৮ জন ফিলিস্তিনি। তবে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ এখনো হাজার হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন।
জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, গাজায় কোনো নিরাপদ স্থান অবশিষ্ট নেই। একদিকে ইসরায়েল অবরোধ দিয়ে খাদ্য, ওষুধ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ রেখেছে, অন্যদিকে অবিরাম বোমা বর্ষণ চলছে। এর ফলে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের জীবন অচল হয়ে পড়েছে।
ইউরোপীয় কমিশন ইসরায়েলের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয় তবে তা সাধারণ ইসরায়েলিদের ওপর প্রভাব ফেলবে। লন্ডনের কুইন ম্যারি ইউনিভার্সিটির ফাইন্যান্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড্যানিয়েল বিয়ানচি বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার ফলে ইসরায়েলে বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং জীবনযাত্রার মান ব্যাহত হবে।
তিনি আরও জানান, রাশিয়ার মতো বড় অর্থনীতি ইচ্ছা করলে দীর্ঘমেয়াদি নিষেধাজ্ঞা সামলাতে পারে। কিন্তু আকারে ছোট হওয়ায় ইসরায়েলের পক্ষে তা কঠিন হবে। এর প্রভাব তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনেও পড়বে।
শুধু গাজাই নয়, অধিকৃত পশ্চিম তীরেও সহিংসতা বেড়ে চলেছে। কিসান গ্রামে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের কৃষিজমি ও ঘরবাড়িতে হামলা চালিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, বসতি স্থাপনকারীরা নিয়মিতভাবেই এসব আক্রমণ চালিয়ে আসছে, তবে এবার তা আরও সহিংস রূপ নিয়েছে। কৃষিজমি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনিরা অভিযোগ করেছেন, এসব আক্রমণ ইসরায়েলি সেনাদের নীরব সমর্থনেই ঘটছে। ফলে তারা কোনো প্রতিরোধ করতে পারছেন না।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানালেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বারবার প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও ভেটো ক্ষমতার কারণে সেগুলো পাশ হয়নি। ফলে গাজায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তবে এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। সূত্র: আল-জাজিরা
গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত হামলা এখন বিশ্বমানবতার জন্য এক ভয়াবহ পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই নতুন করে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ মানুষ, শিশু আর নারী। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা হাজারো মানুষের কান্না কেউ শুনছে না। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার দাবিতে যে চাপ সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল, তা এখনো হয়নি। বরং হামলা আরও বেড়ে চলেছে।
গাজার বর্তমান পরিস্থিতি শুধু ফিলিস্তিনিদের নয়, পুরো বিশ্বের বিবেককেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত এ যুদ্ধ থামাতে শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নাহলে মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হবে, যার দায় এড়াতে পারবে না কেউই।