
জর্জিয়ায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমাতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রাসায়নিক ‘ক্যামাইট’ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। বিবিসি তদন্তে বিক্ষোভকারীদের তীব্র জ্বালা, শ্বাসকষ্টসহ নানা উপসর্গের প্রমাণ মিলেছে।
জর্জিয়ায় গত বছরের সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত একধরনের রাসায়নিক উপাদান প্রয়োগ করা হয়েছিল—বিবিসির বিস্তৃত অনুসন্ধানে এমন ইঙ্গিত উঠে এসেছে। ঘটনাটিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। যদিও জর্জিয়ার সরকার এসব অভিযোগকে ‘অবাস্তব’ দাবি করে পুরো তদন্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
রাস্তার মিছিলে অস্বাভাবিক জ্বালা ও মারাত্মক অস্বস্তি
রাজধানী তিবিলিসিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের প্রক্রিয়া স্থগিতকরণের প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভে নেমেছিল হাজারো মানুষ। ওই সময় পুলিশের জলকামান ব্যবহারে অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকজন নাগরিক জানিয়েছেন, জলকামান থেকে নিক্ষিপ্ত পানি তাদের ত্বকে অস্বাভাবিক জ্বলন সৃষ্টি করেছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেন, সেই ব্যথা মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য নয়, বরং পানি ধুয়ে ফেললেও অনেকক্ষণ স্থায়ী ছিল। অনেকে আবার বলেন, ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেওয়ার পরও শ্বাসকষ্ট, কাশি, বমি ভাব, চোখে জ্বালা এবং মাথা ঘোরা—এমন উপসর্গ দীর্ঘদিন ধরে ছিল।
বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের বক্তব্য
বিবিসির অনুসন্ধান দলের সদস্যরা রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, এবং দাঙ্গা পুলিশের একাধিক হুইসেলব্লোয়ারের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের বক্তব্য বলছে—বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে ‘ক্যামাইট’ (Camaite বা Camite) নামের একটি রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, এ উপাদানটির ইতিহাস প্রায় শতবর্ষের পুরোনো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের সেনাবাহিনী জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে এটি ব্যবহার করেছিল। উপাদানটির প্রভাব সাধারণ দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত টিয়ার গ্যাসের তুলনায় বেশি তীব্র বলে বিবেচিত।
চিকিৎসকদের মতে, যেসব উপসর্গ বিক্ষোভকারীরা জানিয়েছেন, তা সাধারণ টিয়ার গ্যাস বা জলকামানের রাসায়নিক মিশ্রণের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে না। বরং আরও শক্তিশালী কোনো রাসায়নিকের উপস্থিতির সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে।
হুইসেলব্লোয়ারদের দাবি
দাঙ্গা পুলিশের কয়েকজন বেনামি কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, গত বছরের বিক্ষোভের সময় কিছু বিশেষ কন্টেইনার ও তরল উপাদান মজুত করতে দেখা যায়, যা সাধারণ সময়ে ব্যবহৃত হয় না। তাঁদের দাবি, সেগুলো উচ্চ–ক্ষমতাসম্পন্ন রাসায়নিক হতে পারে, যা বিক্ষোভকারীদের দ্রুত ছত্রভঙ্গ করতে কার্যকর হলেও স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।
জর্জিয়া সরকারের প্রতিক্রিয়া
তবে জর্জিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারি মুখপাত্ররা বিবিসির অনুসন্ধানকে ‘অসত্য, উদ্দেশ্যমূলক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন, দেশটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আইনগত নীতিমালা মেনে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কোনো ধরনের নিষিদ্ধ রাসায়নিক ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না।
সরকারের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, তারা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এনে বিবিসির কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাইতে পারে।
আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মানবাধিকার সংগঠন এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ঘটনাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। কারণ বিক্ষোভ দমনে যুদ্ধকালীন রাসায়নিকের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইনে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ইইউ জানিয়েছে, এই অভিযোগ সত্য হলে তা অত্যন্ত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে।
ঘটনা নিয়ে এখনো স্বাধীন কোনো আন্তর্জাতিক তদন্ত শুরু হয়নি। তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত দাবি করেছে।