
বাংলাদেশের জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর সদস্যসচিব আখতার হোসেন যুক্তরাষ্ট্রে তার ওপর হামলার ঘটনায় মামলা করেছেন। নিউইয়র্কে অবস্থানকালে বিমানবন্দর ও হোটেলে হামলার শিকার হওয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি এ মামলা দায়ের করেছেন বলে জানা গেছে। দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তি এবং আখতার হোসেনের ভিডিও বার্তায় বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
হামলার প্রেক্ষাপট
গত সপ্তাহে আখতার হোসেন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান। সফরের শুরুতেই নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি (JFK) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কিছু লোক তাকে লক্ষ্য করে হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। তার ভাষ্য অনুযায়ী, এ হামলাকারীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংগঠিত হয়ে তাকে টার্গেট করে। তিনি দাবি করেন, বিমানবন্দরে হামলার পরপরই ওই একই গোষ্ঠী হোটেলের লবিতে পুনরায় আক্রমণের চেষ্টা চালায়। তবে সেখানে উপস্থিত এনসিপির স্থানীয় সদস্যরা ও সমর্থকেরা হামলাকারীদের প্রতিহত করতে সক্ষম হন।
এ ঘটনার পরপরই স্থানীয় পুলিশকে অবহিত করা হয়। পুলিশ ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় আখতার হোসেন নিউইয়র্কের একটি থানায় গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা দায়ের করেন।
আখতার হোসেনের অভিযোগ
ফেসবুক লাইভে দেওয়া বার্তায় আখতার হোসেন বলেন, “আমার ওপর হামলাকারীরা শুধু আমাকে শারীরিকভাবে আঘাত করার চেষ্টা করেনি, বরং এটি সরাসরি হত্যাচেষ্টা ছিল। তারা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়ে এ কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেও তারা একই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে চাইছে।”
তিনি অভিযোগ করেন, এই হামলাকারীরা বাংলাদেশের একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ সংগঠন অতীতে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ছিল। আখতার হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশকে জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিবেদনও দেখিয়েছেন, যেখানে এ সংগঠনের অপরাধের বিবরণ রয়েছে।
এনসিপির প্রতিক্রিয়া
জাতীয় নাগরিক পার্টি এক বিবৃতিতে ঘটনাটির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছে, দেশের বাইরে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের ওপর এ ধরনের হামলা কেবল ব্যক্তি নয়, বরং গণতান্ত্রিক চর্চার ওপর আঘাত। দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, নিউইয়র্কে আখতার হোসেনের সফর ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও সাংগঠনিক উদ্দেশ্যে। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে তাকে রাজনৈতিকভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা চালানো হয়েছে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা, যিনি ওই সময় আখতার হোসেনের সঙ্গে ছিলেন, তিনিও হামলার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, হামলাকারীরা “আওয়ামী সন্ত্রাসী” পরিচয়ে নিজেদের প্রকাশ করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে মামলার প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক সহিংসতা বা বিদেশি নাগরিকদের ওপর হামলার ঘটনা সাধারণত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। কারণ দেশটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর নীতি অনুসরণ করে। আখতার হোসেন যে মামলা করেছেন, তা তদন্তের আওতায় আনবে স্থানীয় পুলিশ। প্রয়োজন হলে এফবিআই বা অন্যান্য ফেডারেল সংস্থাও জড়িত হতে পারে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি হামলাকারীদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়, তবে তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ফৌজদারি মামলা হতে পারে। এছাড়া হামলাকারীরা যদি অভিবাসী হয়ে থাকে, তবে তাদের ভিসা বা অভিবাসন-সংক্রান্ত সমস্যারও মুখোমুখি হতে হবে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রতিধ্বনি
বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে এ ঘটনা ইতিমধ্যে আলোড়ন তুলেছে। অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বিদেশে বসবাসরত নেতাদেরও প্রভাবিত করছে। অতীতে ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তবে সরাসরি মামলা দায়ের করে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া একটি নতুন দৃষ্টান্ত।
কূটনৈতিক মহলে ধারণা করা হচ্ছে, এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও রাজনৈতিক সহিংসতা রোধে কঠোর অবস্থান নেয়। ফলে, আখতার হোসেনের মামলার তদন্তে বের হয়ে আসা তথ্য-প্রমাণ বাংলাদেশি রাজনীতির ওপর আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।
ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রসঙ্গ
আখতার হোসেন তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবস্থায় তার ও তার দলের নেতাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে। তিনি পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করবেন বলেও জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানান, রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও সহিংসতায় না জড়িয়ে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতি আস্থা রাখতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
ঘটনাটি প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এনসিপি নেতাকর্মীরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সমর্থকেরা দাবি করছেন, এ হামলা পরিকল্পিত এবং বাংলাদেশে বিরোধী রাজনীতিকে স্তব্ধ করার আন্তর্জাতিক রূপ। অন্যদিকে শাসকদল-সমর্থিত কিছু ব্যক্তি এ ঘটনাকে অতিরঞ্জিত বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, এটি রাজনৈতিকভাবে প্রচারণা বাড়ানোর কৌশলও হতে পারে।
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
এখন পর্যন্ত মামলাটি প্রাথমিক তদন্ত পর্যায়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে হামলাকারীদের নাম প্রকাশ করেনি। তবে আখতার হোসেন আশাবাদী যে, তদন্তে প্রকৃত তথ্য বের হয়ে আসবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ঘটনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। প্রবাসী রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়তে পারে – বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে বিভাজন তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।আইনগত নজির তৈরি হতে পারে – বাংলাদেশি নেতারা বিদেশে আক্রান্ত হলে স্থানীয় আইনের আশ্রয় নিতে উৎসাহিত হবেন। আন্তর্জাতিক মহলের নজর কাড়বে – বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার বিষয়টি আবারও বিশ্বমিডিয়ায় আলোচিত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে আখতার হোসেনের ওপর হামলার ঘটনা এবং তার পরবর্তী মামলার পদক্ষেপ কেবল একটি ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়; এটি বাংলাদেশি রাজনীতির বৈশ্বিক প্রতিফলনও বটে। প্রবাসে থেকেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, ভীতি প্রদর্শন এবং সহিংসতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এখন দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রের আদালত ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কীভাবে এ মামলার অগ্রগতি ঘটায় এবং এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সহিংসতা রোধে কোনো বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায় কি না।